ওসমান হাদীর প্রস্থান: থেমে যাওয়া এক নাগরিক কণ্ঠ

শরীফ ওসমান হাদীর মৃত্যু আমাদের সময়ের এক গভীর অস্বস্তিকর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘ চিকিৎসার পর সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যুবরণ কেবল একজন ব্যক্তির জীবনাবসান নয়; এটি নাগরিক পরিসরে সহিংসতার অনুপ্রবেশের একটি করুণ দলিল। তাঁর প্রস্থান আমাদের মনে করিয়ে দেয়—যখন মতপ্রকাশ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে, তখন গণতন্ত্রের শ্বাসও সংকুচিত হয়।
ওসমান হাদী ছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত এক দৃশ্যমান নাগরিক কণ্ঠ। সমসাময়িক রাষ্ট্র ও সমাজের নানা অসংগতি নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্যের ভাষা কারও কাছে তীব্র, কারও কাছে বিতর্কিত হতে পারে, কিন্তু এটিকে অস্বীকার করার উপায় নেই যে তিনি নাগরিক আলোচনায় এক ধরনের সক্রিয়তা ও প্রশ্নমুখরতা সৃষ্টি করেছিলেন। এই দৃশ্যমানতাই একদিকে তাঁকে পরিচিত করেছে, অন্যদিকে হয়তো তাঁকে ঝুঁকির মুখেও ঠেলে দিয়েছে—এই আশঙ্কা আজ অস্বাভাবিক নয়।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাঁর চিকিৎসাপথ আমাদের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে কঠিন প্রশ্ন তোলে। একজন গুরুতর আহত নাগরিককে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিতে হয়—এটি শুধু ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার প্রতিফলন। শেষ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের মতো চিকিৎসাসুবিধাসম্পন্ন দেশেও তাঁর জীবন রক্ষা করা যায়নি। এই মৃত্যু আমাদের দেখায়, সহিংসতার ক্ষত কতটা গভীর হতে পারে—যে ক্ষত চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাকেও অনেক সময় পরাস্ত করে।
এই ঘটনার সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো—গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রকৃত প্রেক্ষাপট এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। কে বা কারা, কী কারণে এবং কোন পরিস্থিতিতে এই সহিংসতা ঘটিয়েছে—এসব প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য উত্তর না মিললে শোকের সঙ্গে সঙ্গে অনিশ্চয়তাও বাড়ে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো সহিংস মৃত্যুই প্রশ্নহীন থাকতে পারে না। বিশেষ করে যখন সেই মৃত্যু একজন পরিচিত নাগরিক কণ্ঠের, তখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব আরও গভীর হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত—যার মাধ্যমে কেবল ঘটনা নয়, ঘটনার পেছনের বাস্তবতাও উদ্ঘাটিত হবে।
শরীফ ওসমান হাদীর দাফন-কাফনে লাখো মানুষের অংশগ্রহণ একটি তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক বার্তা বহন করে। এই জনসমাগম কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না; ছিল নীরব প্রতিবাদ ও সম্মিলিত শোকের প্রকাশ। মানুষের এই উপস্থিতি জানান দেয়, তিনি একা ছিলেন না—তাঁর কণ্ঠে অনেকেই নিজেদের অনুভব খুঁজে পেয়েছিলেন। সহিংসতার মাধ্যমে একটি কণ্ঠ থামানো গেলেও, প্রশ্ন ও উদ্বেগকে থামানো যায় না—এই বাস্তবতাই যেন আজ দৃশ্যমান।
ওসমান হাদীর পরিচয় কোনো প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার প্রতিনিধি হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন নাগরিক পরিসরের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তাঁর উচ্চারণ অনেক সময় অস্বস্তিকর হলেও, তা বাস্তবতারই প্রতিফলন। বৈষম্য, জবাবদিহির অভাব, নাগরিক অধিকার—এই বিষয়গুলো নতুন নয়, কিন্তু সেগুলোকে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে আনার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল লক্ষণীয়। এই ভূমিকার মূল্যায়ন করতে গিয়ে আবেগ নয়, বরং নীতিগত অবস্থানই হওয়া উচিত আমাদের মানদণ্ড।
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ভিন্নমতে। ভিন্নমতকে জায়গা না দিলে সমাজ স্থবির হয়ে পড়ে। কিন্তু যখন ভিন্নমত সহিংসতার শিকার হয়, তখন সেটি শুধু একটি কণ্ঠকে নীরব করে না—এটি অন্য বহু কণ্ঠের মাঝেও ভয় সৃষ্টি করে। ওসমান হাদীর মৃত্যু সেই ভয়কে স্পষ্ট করে তুলেছে। আমরা কি এমন এক সমাজের দিকে এগোচ্ছি, যেখানে প্রশ্ন তোলা মানেই ঝুঁকি নেওয়া? এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া এখন অনিবার্য।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখানে দ্বিমুখী। একদিকে সহিংসতার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও দায় নির্ধারণ, অন্যদিকে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। তদন্ত যদি কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা আস্থার সংকট আরও গভীর করবে। শরীফ ওসমান হাদীর মৃত্যুর সত্য উদ্ঘাটন রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যকার বিশ্বাস পুনর্গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।
এই ঘটনায় নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবেগঘন শিরোনাম কিংবা অনুমাননির্ভর ব্যাখ্যার পরিবর্তে প্রয়োজন তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধান ও সংযত ভাষা। গণমাধ্যমের দায়িত্ব কেবল সংবাদ পরিবেশন নয়; প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করা, প্রশ্ন তোলা এবং জবাবদিহির দাবি জানানোও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সহিংসতা যেমন উৎসাহ পায়, তেমনি গুজবও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
ওসমান হাদীর মৃত্যু তরুণদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়েও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। তিনি দেখিয়েছিলেন, তরুণেরা কথা বলতে চায়, প্রশ্ন করতে চায়। এই আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা বা দমন করলে তা হতাশা ও ক্ষোভে রূপ নিতে পারে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই অংশগ্রহণকে নিরাপদ ও গঠনমূলক পথে প্রবাহিত করা—যাতে মতপ্রকাশের মূল্য কাউকে জীবন দিয়ে দিতে না হয়।
এই ট্র্যাজেডি আমাদের জন্য একটি আত্মসমালোচনার সুযোগও এনে দিয়েছে। সহিংসতার বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা, মতপ্রকাশের নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে আমাদের অবস্থান কতটা দৃঢ়—তা নতুন করে মূল্যায়ন করা জরুরি। যদি এই মৃত্যু আমাদের কিছু শেখাতে পারে, তবে সেটি হলো—নীরবতা কোনো সমাধান নয়; বরং আলোচনাই অন্ধকার দূর করার সবচেয়ে কার্যকর পথ।
শরীফ ওসমান হাদী আর নেই, কিন্তু তিনি যে প্রশ্নগুলো রেখে গেছেন, সেগুলো রয়ে গেছে। সেই প্রশ্নগুলোর সৎ, সাহসী ও দায়িত্বশীল উত্তর দেওয়াই হবে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা। থেমে যাওয়া একটি নাগরিক কণ্ঠের স্মৃতিকে ধারণ করে, সহিংসতার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে মতপ্রকাশের নিরাপদ পরিসর নিশ্চিত করাই আজ রাষ্ট্র, সমাজ ও আমাদের সবার প্রধান দায়িত্ব।
লেখক:
জিয়াউদ্দিন লিটন
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
২০ ডিসেম্বর ২০২৫