গণতন্ত্রের ভাষা ব্যালটের—বুলেটের নয়

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্বাচন মানেই এখন আর শুধু ভোটের লাইন বা ব্যালট বাক্স নয়। নির্বাচন ঘিরে ক্রমশ জমে উঠছে ভয়, উত্তেজনা আর রক্তপাতের সংস্কৃতি। রাজনৈতিক মতপার্থক্য যেখানে কথা ও যুক্তিতে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেখানে আজ অনেক ক্ষেত্রেই নিষ্পত্তি হচ্ছে হামলা আর খুনের মাধ্যমে। ফলে প্রশ্নটা শুধু কে মরলো—সেখানে আটকে নেই; প্রশ্নটা আরও গভীরে গিয়ে দাঁড়ায়—এই মৃত্যুগুলো কার স্বার্থ রক্ষা করছে, আর কোন ইঙ্গিতে ঘটছে?
সাম্প্রতিক সময়ের মানবাধিকার ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো এক ধরনের অস্বস্তিকর ছবি তুলে ধরছে। মাত্র এক বছরের একটু বেশি সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, আহত হয়েছে কয়েক হাজার। সংঘর্ষের সংখ্যাও নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। এই পরিসংখ্যান হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনার ইঙ্গিত দেয় না; বরং একটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক প্রবণতার দিকেই আঙুল তোলে।
যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের বড় একটি অংশ রাজনীতির মাঠের মানুষ—কর্মী, সংগঠক কিংবা স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মী। দলীয় বিরোধ, মনোনয়ন ঘিরে দ্বন্দ্ব, কিংবা প্রভাব বিস্তারের লড়াই—এসবই অনেক সময় সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, সহিংসতা শুধু প্রতিপক্ষকে দমনের কৌশল নয়; অনেক ক্ষেত্রে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে।
আরও জটিল বাস্তবতা হলো—সব খুনের পেছনে প্রকাশ্য বিরোধ থাকে না। কোথাও কোথাও অদৃশ্য ইঙ্গিত কাজ করে, স্থানীয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কিংবা ক্ষমতার আশ্রয়ে থাকা কিছু শক্তি পরিকল্পিতভাবে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে। এতে করে রাজনীতির মাঠে সাধারণ মানুষ ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন আর গণতন্ত্রের উৎসব থাকে না; তা হয়ে ওঠে এক ধরনের আতঙ্কের প্রতিযোগিতা। মানুষ ভোট দিতে চায়, কিন্তু তার আগে সে নিশ্চিত হতে চায়—সে নিরাপদ তো? ভোটাধিকার যখন জীবন-নিরাপত্তার প্রশ্নে আটকে যায়, তখন গণতন্ত্র কার্যত দুর্বল হয়ে পড়ে।
সংখ্যাগুলো তাই শুধু পরিসংখ্যান নয়। প্রতিটি সংখ্যার ভেতরে আছে একটি ভাঙা পরিবার, থেমে যাওয়া একটি জীবন, নিঃশেষ হয়ে যাওয়া একটি সম্ভাবনা। এসব সংখ্যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাজনৈতিক সহিংসতা আসলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যর্থতারই প্রতিফলন।
গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষের নিরাপদ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই হবে। খুনের পেছনের নির্দেশদাতা, ইঙ্গিত ও উদ্দেশ্য চিহ্নিত না হলে; দ্রুত বিচার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রতিষ্ঠিত না হলে—নির্বাচন নামের আয়োজন কেবলই অনিশ্চয়তা আর রক্তক্ষয়ের স্মৃতি হয়ে থাকবে।
গণতন্ত্রের ভাষা ব্যালটের—বুলেটের নয়।
এই সত্যটা যদি আমরা সময়মতো বুঝতে না পারি, তবে প্রতিটি নির্বাচনই আমাদের আরও দূরে ঠেলে দেবে গণতন্ত্রের মূল চেতনা থেকে।
জিয়াউদ্দিন লিটন
লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট